বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী চীনা বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী এবং পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চেন নিং ইয়াং ১০৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। শনিবার (১৮ অক্টোবর, ২০২৫) চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিসিটিভি এক প্রতিবেদনে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশিত শোকবার্তায় সিসিটিভি জানিয়েছে, এই বরেণ্য বিজ্ঞানী বার্ধক্যজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। পদার্থের মৌলিক উপাদান এবং কণা পদার্থবিজ্ঞানে ইয়াং-এর যুগান্তকারী অবদান তাঁকে বিশ্ব বিজ্ঞান ইতিহাসে অমর করে রাখবে।
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চেন নিং ইয়াংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল ‘প্যারিটি ল’ বা ‘সাম্য নীতি’ সংক্রান্ত গবেষণা। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে তিনি তার সহকর্মী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ লি স্যুং-ডাও-এর সঙ্গে যৌথভাবে এই যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল কমিটি তাদের এই গবেষণাটির প্রশংসা করে বলেছিল, এটি ছিল এক ‘‘তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান, যা পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক কণিকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে।’’ ইয়াং-এর এই মৌলিক আবিষ্কারটি পদার্থবিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নিয়মগুলোকে নতুন করে পরীক্ষা করতে বাধ্য করে এবং তা বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে।
১৯২২ সালে চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন চেন নিং ইয়াং। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে বেইজিংয়ের খ্যাতনামা সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, যেখানে তাঁর বাবা ছিলেন গণিতের একজন অধ্যাপক। কৈশোরেই তিনি তাঁর বাবা-মায়ের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার—নোবেল জয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন এবং ৩৫ বছর বয়সে তিনি তা অর্জন করেন। ইয়াং ১৯৪২ সালে কুনমিংয়ের ন্যাশনাল সাউথওয়েস্ট অ্যাসোসিয়েটেড ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
চীন-জাপান যুদ্ধের শেষে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি ইতালীয় পদার্থবিদ এনরিকো ফারমির অধীনে কাজ করার মূল্যবান সুযোগ পান। এনরিকো ফারমি ছিলেন সেই বিজ্ঞানী, যিনি বিশ্বে প্রথম সফল পারমাণবিক চুল্লি উদ্ভাবন করেছিলেন।
দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ কর্মজীবনে চেন নিং ইয়াং পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় অবদান রেখেছেন। বেইজিংয়ের খ্যাতনামা সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন এবং একই প্রতিষ্ঠানের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির সম্মানসূচক ডিনের দায়িত্বও পালন করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫৭ সালে তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন স্মারক পুরস্কার এবং ১৯৫৮ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনেও ইয়াং ছিলেন আলোচিত। ১৯৫০ সালে প্রথম স্ত্রী চি লি তু-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় এবং তাঁদের তিন সন্তান ছিল। ২০০৩ সালে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ২০০৪ সালে ওয়েং ফানকে বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বয়সে ৫০ বছরেরও বেশি ছোট ছিলেন। ওয়েংকে তিনি ‘ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত শেষ আশীর্বাদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বিশ্ব বিজ্ঞান জগতে এই প্রভাবশালী পদার্থবিজ্ঞানীর প্রয়াণ নিঃসন্দেহে এক অপূরণীয় ক্ষতি, যা চিরকাল বিজ্ঞানপ্রেমী প্রজন্মকে মৌলিক গবেষণার পথে অনুপ্রাণিত করবে।
Leave a Reply